↬ ২৬ মার্চ, ১৯৭১
↬ জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব
ভূমিকা :
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি–প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে।
— শামসুর রাহমান
কবিতার এ ছত্রেই লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। স্বাধীনতার বীজপত্র হিসেবে এমন
একটি কবিতাই যথেষ্ঠ। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। অনাহারী একজন গৃহহীন পথের
লোকও ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীনতা কামনা করে। স্বাধীনতার অর্থ পরাধীনতার শৃঙ্খল
থেকে মুক্ত হয়ে সার্বভৌম আত্মমর্যাদা নিয়ে দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রা। স্বাধীনতা
প্রত্যেক জাতির অমূল্য সম্পদ। যে জাতি যেদিন স্বাধীনতা লাভ করে সেদিনটি জাতীয়
জীবনে এক গৌরবান্বিত, আনন্দঘন ও তাৎপর্যময় দিন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস : স্বাধীনতা যে কোনো জাতির জন্যে একটি
গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। স্বাধীনতা আমাদের সামনে স্বর্ণ দুয়ার খুলে দেয়। যে দুয়ার
দিয়ে প্রবেশ করে আমরা আমাদের যুগসঞ্চিত জঞ্জাল দূর করার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম।
স্বাধীনতা দিবস জাতীয় জীবনের একটি লাল তারিখ, স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ২৬ এ মার্চ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের
মুক্তিসংগ্রামের। ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ এ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নামের
অন্তর্ভুক্তি ঘটে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস এ দিনটিকে ঘিরে রচিত হয়েছে। এ দিনের
নবীন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
স্বাধীনতা দিবস জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদার বর্ণিল স্মারক। ১৯৭১ সালের ২৬ শে
মার্চ আমরা বিশ্বের বুকে যে স্বাধীন সত্তার জানান দিয়েছিলাম, তা আজো মাথা উঁচু
করে রেখেছে আমাদের। সে এক আশ্চর্য সময় এসেছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। সৃষ্টি হয়েছিল
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো অসংখ্য অবিস্মরণীয় ঘটনা কাহিনীর। পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল
স্বাধীনতার জন্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। রক্তস্নাত দোঁআশ মাটি ভিত্তি করে আবির্ভাব
ঘটেছিল নতুন করে এ জতির। যে যেভাবে পারে অংশগ্রহণ করেছিল এই মহান মুক্তিযুদ্ধে।
এক অবিস্মরণীয় সম্মিলনের ঐকতানে মিলিত হয়েছিল এ জাতি। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐকতানে
সিম্ফনিতে মিলিত হয়েছিল সবাই। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এ স্বাধীনতা।
আমরা ভুলি নি — ভুলি নি সেই বীরত্ব গাঁথা, ভুলিনি শহীদদের মহান আত্মত্যাগ।
অন্যান্য ঘটনা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশ্বের স্বাধীনতা অর্জনের
ইতিহাসে একটি আদর্শ –উজ্জ্বল দিক। কোনো জাতিকেই জন্মভূমির জন্য এতো করে এমনভাবে
আত্মত্যাগ করতে হয় নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সম্পদ দিয়ে,
সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার মহান পতাকা এদেশের সুজলা – সুফলা – শস্য – শ্যামল
ভূমিতে উঠাতে সক্ষম হয়েছিল। এজন্যে এ দেশের মানুষকে সহায় সম্বলহীন অবস্থায়
সংগ্রাম করতে হয়েছিল অস্ত্র সজ্জিত এক শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে। অবশেষে তারা
সেই অকুতোভয় সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। ফলে আমরা লাভ করেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ—
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি : ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের
ভিত্তিতে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ ব্রিটিশ — ভারত থেকে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক
রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন এই স্বাধীন বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান
এবং এটি তখন পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের
প্রত্যাশা ছিল তাদের সব ধরনের দমন – নিপীড়ন, অন্যায় – অত্যাচার শাষন – শোষনের
অবসান ঘটবে। কিন্তু শোষণ ও বঞ্চণার অবসান হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতে
পাকিস্তানি শাসকচক্র এ অঞ্চলে তাদের তাবেদারদের মাধ্যমে অত্যাচারের স্টিমরোলার
চালিয়েছিল। শোষণ – নিপীড়ন – নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল এদেশের মানুষ। তখন
এদেশের মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শাসকচক্রের মুখোশ। তখন
থেকেই বাঙালির মনে স্বাধীনতার চেতনা সঞ্চায়িত হতে থাকে।
আমাদের ভাষা – সাংস্কৃতিক – ভৌগলিক অবস্থান সবকিছুই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন
প্রক্রিয়ার বিপক্ষে। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতেই আঘাত আসে আমাদের ভাষার ওপর।
তৎকালীন শাসকচক্র উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে জোর করে ঘোষণা
করলে প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এদেশের ছাত্র সমাজ এবং সাধারন মানুষ। ১৯৪৭ সাল
থেকে একটু একটু করে ভাষার জন্যে সঞ্চারিত হওয়া আন্দোলন আস্তে আস্তে বেগবান হয়ে
চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালে। রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশের মানুষ তাদের
মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের গরবিনি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার
মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে
বীজ প্রোথিত করেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষা শহীদেরা, তারই স্মারক আজকের স্বাধীন
সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বোত্তম প্রাপ্তি বাঙালির —
বাংলা ভাষাভাষী মানুষের স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা দিবস ও বিভিন্ন আন্দোলন : স্বাধীনতা একটি শব্দ শব্দ হলেও তা
কখনোই একক কোনো দিবস বা কার্যের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। একে অর্জন করতে, একে পেতে
হলে অনেক ত্যাগ অনেক আত্মহুতি অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও
একদিনে আসে নি। কিংবা একক কোনো প্রচেষ্টার বিনিময়ে অর্জিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ঘটা
বিভিন্ন দমন নিপীড়ন ও শোষণ বঞ্চনার প্রস্ফুট বিস্ফোরণের ফল হল আজকের স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের পশ্চাতে রয়েছে — ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট
নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা
আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনেরই অংশ। স্বৈরাচারী
পাকিস্তান শাসক বারবার চেষ্টা করেও এদেশের মানুষকে দমন করতে পারে নি। ১৯৭০ সালের
নির্বাচনে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ কে ভোট দিয়েছিল, এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ
সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও সরকার গঠন করতে পারে নি। নির্বাচনে জয়ের পরেও
সংসদে বসতে দেয়নি পাকিস্তানি শাসকচক্র। তারা বিন্দুমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকারের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়নি। স্বৈরাচারী পাকিস্তান শাসকচক্র ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে
বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করেছিল। ফলে ক্ষমতায় যেতে পারে নি এদেশের মানুষ।
প্রতিবাদে গর্জে উঠলো তারা। পাকিস্তানি হায়েনারা এদেশের ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর
নির্বিচারে হামলা চালাল, নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রচনা করতে থাকলো একের
পর এক বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজেদের মুক্তির
আন্দোলনে, জড়িয়ে পড়ল মহান মুক্তিযুদ্ধে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস : ১৯৭১ সালের ২৫ এ মার্চ অন্ধকার রাত্রিতে পাক
হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র অবস্থায় অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তারা নির্বিচারে চালায় হত্যাযজ্ঞ। ২৫ এ মার্চ রাতে ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি
থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬ এ মার্চ যার যা আছে তাই নিয়ে সর্বত্র
শত্রুর মোকাবিলা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করে যে
যেভাবে পারেন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে একত্র হন। গ্রামে – গঞ্জে
স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক, কৃষক, সৈনিক, পুলিশ, আনসার সবাই মিলে
যার যার অঞ্চলে আঞ্চলিক কমান্ড তৈরি করে বিক্ষিপ্তভাবে শত্রুর ওপর আক্রমন চালাতে
থাকে। কতিপয় বিবেকহীন বিশ্বাসঘাতক আলবদর, রাজাকার, আল — শামস ছাড়া গোটা জাতি
মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ —এ মার্চ চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র হতে
চট্টগ্রামের স্থানীয় জননেতা আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে স্বাধীনতার ঘোষণা
পাঠ করেন। ২—৩ মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত ও অসংগঠিত অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ত
প্রতিরোধ যুদ্ধ চলতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল
ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন
করা হয়। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার নেতৃত্ব দেয়।
দেশের সমগ্র সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় গ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের
নেতা কর্মীদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠতে থাকে।
চার পাঁচ মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের গতিবিধি ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর ভারত
সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করা শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে
প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম বৈপ্লবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ দিকে দেশের অভ্যন্তরে পাক
— হানাদার বাহিনীর ওপর চলে প্রচণ্ড গেরিলা আক্রমণ।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে সমগ্র বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য
এগারটি সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধ
সংগঠিত ও তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিপ্লবী
অনুষ্ঠান ও রণসংগীত মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশবাসীকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করে এই যুদ্ধে
উৎসাহিত করতে থাকে। প্রবাসী সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর
কাছে আবেদন জানায় এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চলে। এমনিভাবে নয়
মাস যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভূখণ্ড স্বাধীনতা লাভ
করে।
স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন : প্রতিবছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য
আমরা ওই দিন ভোরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শহীদদের প্রতি
শ্রদ্ধা জানাই। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এ দেশের সর্বস্তরের জনগণ নানা অনুষ্ঠানের
আয়োজনের মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। এ দিনের
অনুষ্ঠানমালা আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত ও উজ্জীবিত করে।
স্বাধীনতার চেতনা ও তাৎপর্য : আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনটির প্রধান তাৎপর্য
হচ্ছে— এ দিনটি সমগ্র দেশবাসীর বহুকাল লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে
ভাস্বর। এই স্বাধীনতা দারিদ্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে মানবাধিকার
প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ। স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছর পর এখনো অসংখ্য লোক
অশিক্ষিা ও দারিদ্র্য কবলিত অবস্থায় রয়েছে। জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত
হচ্ছে। বেকারত্বের জালে আবদ্ধ যুবক বেছে নিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয় ও সমাজবিরোধী পথ।
এখনো আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারি নি। লক্ষ লক্ষ
মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সুখী – সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পৃথিবীর
বুকে প্রতিষ্ঠিত করা।
পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় : অজস্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যাতে
কারো ব্যক্তিগত বা দলগত চোরাবালিতে পথ না হারায় সেই প্রচেষ্টা আমাদের গ্রহণ করতে
হবে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, স্বাধীনতা
রক্ষা করা আরো কঠিন। আজ বিশ্বের দিকে দিকে উৎকর্ষ সাধনের প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে
আমাদেরও সৃষ্টি করতে হবে উন্নয়নের ধারা। দেশ গড়ার কাজে আজ প্রয়োজন সমগ্র জাতির
নতুন করে শপথ গ্রহণ। সর্বপ্রকার স্বৈরতন্ত্র থেকে থেকে দেশকে মুক্ত করে
আত্মশক্তিকে বলীয়ান হয়ে উঠতে হবে।তবেই গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা বনাম অপশক্তি : যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে স্বাধীনতা
সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত চার দশকেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা
স্পর্শ করতে পারে নি। স্বাধীনতার পর বার বার সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা আর
রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী দেশি ও বিদেশী
ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুব সমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা,
বেকারত্বের হার, জনস্ফীতি, আইনশৃংখলার অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষয়
স্বাধীনতার মূল্য লক্ষ্য বা চেতনাকে বিপন্ন করে চলছে। স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী
কার্যকলাপ বার বার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাহিরে। প্রকৃত
স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনপ্রিয় মানুষ তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার হতে বারবার
বঞ্চিত হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন
দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক
পদক্ষেপ। এজন্য দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা
প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন স্বাধীনতার প্রকৃত গৌরবগাথা আর আত্মত্যাগের সত্যিকার
ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
স্বাধীনতা দিবসে দেশবাসীর করণীয় : স্বাধীনতা দিবসে শপথ নিতে হবে যে,
বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতাকে জাতীয় জীবনে স্থিতিশীল করে রাখার শথপ নিয়ে দেশ ও
জাতির জন্যে আমরা আমাদের কাজ করে যাব। স্বাধীনতা দিবসের চেতনাকে আমাদের জাতীয়
জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। দেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই
স্বাধীনতা দিবসের সত্যিকারের তাৎপর্য আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হব। আমাদের জাতীয়
জীবনের বিভিন্ন সমস্যা, সংকট, অভাব, অনটন, অশিক্ষা, দারিদ্র্য দূর করে দেশকে একটি
আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সকল দিক থেকে
অর্থবহ হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা এলেও অর্থনৈতিক
মুক্তি এখনো আসে নি। অর্থনৈতিক মুক্তি আসলেই স্বাধীনতা দিবসের চেতনা বাস্তবায়ন
সম্ভব হবে, আমাদের সকলকে তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে, জাতির কল্যাণের জন্যে
একত্রে কাজ করে যেতে হবে।
উপসংহার : স্বাধীনতা একজন মানুষের জন্মগত অধিকার। অনেক রক্ত, ত্যাগ —
তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। এর জন্যে ৩০ লাখ
মানুষকে শহীদ হতে হয়েছে, ২ লাখ মা—বোনকে তাদের ইজ্জত দিতে হয়েছে। আমরা এখন
স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ স্বাধীনতাকে আমাদের যে কোনো মূল্যে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
স্বাধীনতার চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে। সুখী,
সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে পারলে স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন পূরণ হবে।
আরো দেখুন :