↬ দেশপ্রেম
↬ জাতীয় জীবনে স্বদেশপ্রেমের গুরুত্ব
↬ মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
↬ স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম
ভূমিকা :
‘যখন ঈশ্বর ভক্তি এবং সর্বলোকে প্রীতি এক, তখন বলা যাইতে পারে যে
ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতি সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম।’
-বঙ্কিমচন্দ্র।
নিজের দেশকে ভালোবাসে না এমন কে আছে? নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত গুণ। সামাজিক মানুষের দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধই হল দেশপ্রেমের উৎস। বৃহত্তর অর্থে মানুষ ধরিত্রীর সন্তান। এই বিশাল বিশ্বের যে ভূখণ্ডে মানুষ জন্ম নেয়, যে দেশের আলো বাতাস ধূলিকণায় তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস, যে দেশের ধর্ম, ভাষা, পালাপার্বণে তার একাত্ম হওয়ার আকুতি ও মুক্তি সেই দেশই হল তার স্বদেশ। সেই দেশের মানুষই হল তার স্বজন। আর সেই দেশের প্রীতিই হল তার স্বদেশপ্রেম। দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত গুণ। সামাজিক মানুষের গভীর মমত্ববোধই হলো দেশপ্রেমের উৎস, স্বজাতি-প্রীতির বন্ধন। দেশপ্রীতি তাই মানুষের এক মহৎ উত্তরাধিকার। জননী জন্মভূমি তখন স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী মহিমায় দীপ্ত। মানুষের তখন একটাই প্রার্থনা-
‘আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন, এই দেশেতেই মরি।’
কিংবা,
-রবীন্দ্রনাথ
দেশপ্রেমের স্বরূপ, চেতনা ও দৃষ্টান্ত :
‘স্বদেশপ্রেম থেকে বিশ্বপ্রেম, যে নিজের দেশকে ভালোবাসে, সে বিশ্বপ্রেমিক, মানব-প্রেমিক মানবতাবাদী।’
-সমুদ্র গুপ্ত।
দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত গুণ। যে কোনো ব্যক্তি স্বদেশের মাটি, স্বদেশের পানি, আকাশ-বাতাস, পরিবেশ, মানুষ, কৃষ্টি- এই সবকিছুর মধ্যে শিশুকাল থেকেই সে মায়ের আদলে পুষ্ট হতে থাকে। তার দেহ মন বিশ্বাস আদর্শ সবকিছুই স্বদেশের বিভিন্ন উপাদান দ্বারা পুষ্ট। ফলে স্বদেশের জন্যে তার যে প্রেম তা কৃতজ্ঞতার, কর্তব্যের এবং দায়িত্বের। বস্তুত মা, মাটি ও মানুষকে ভালোবাসার মধ্যেই দেশপ্রেমের মূল সত্য নিহিত। তাই সে দেশের ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি এবং জীবন ও পরিবেশকে ভালোবাসতে শুরু করে। এই ভালোবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম। শুধু মুখে মুখে এই ভালোবাসার কথা বললেই দেশপ্রেম হয় না। চিন্তায়, কথায় ও কাজে দেশের জন্য যে ভালোবাসা প্রকাশ পায় সেটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, স্বদেশপ্রেম যেসব বৈশিষ্ট্য দ্বারা উজ্জ্বল সেগুলো হল- আত্মত্যাগ, বীরত্ব, সরলতা, শর্তহীনতা, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব, কর্তব্য এবং একাত্মবোধ।
গর্ভধারিণী জননীকে সন্তান যেমন ভালোবাসে, তেমনি দেশ-মাতৃকাকেও মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই শ্রদ্ধা করতে এবং ভালোবাসতে শেখে। দেশ যত ক্ষুদ্র বা যত দরিদ্রই হোক না কেন, প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে তার জন্মভূমি, তার দেশ, সবার সেরা। যে কোনো ব্যক্তির সকল প্রাপ্তি তার স্বদেশের অবদান বলে স্বদেশের প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে তার ধন, জন, মান, এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। দেশ ও জাতির জীবনে যেমন সুখ আর ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য তখন মানুষের স্বদেশপ্রেম থাকে গভীর ঘুম-ঘোরে মগ্ন। দুঃখ, নির্যাতনের আঘাতে আঘাতেই হয় সেই সুপ্তি-মগ্নতার আবরণ উন্মোচন। দেশের যখন সংকট-মুহূর্ত, যখন বহিঃশত্রুর উল্লাস-অভিযানে দেশের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত, যখন পরাধীনতার বিষজ্বালায় জর্জরিত মানুষ মুক্তি-কামনায় উদ্বেল-অস্থির, যখন রক্তচক্ষু বিদেশি শাসকের নির্যাতন চরমে, তখনই আসে মানুষের স্বদেশ-প্রেমের অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষালগ্ন। তখনই দেশের মর্যাদার জন্যে মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেয়। শত শত শহীদের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই হয় দেশপ্রীতির প্রাণ-প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও জাতীয়তাবোধ হল স্বদেশপ্রেমের প্রধান উৎস। কত বীরের আত্মবলিদানে তখন স্বদেশের মৃত্তিকা হয় রক্তে রাঙা। অতীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তো স্বদেশ-প্রীতিরই জ্বলন্ত স্বাক্ষর।
স্বদেশপ্রেম অকৃপণ, উদার এবং খাঁটি। তা জীবনের প্রতি প্রেমকেও ছাড়িয়ে যায়। স্বদেশপ্রেমের এই সর্বগ্রাসী দিকটি এডউইন আর্নল্ডের ভাষায় চমৎকার ফুটে ওঠে:
‘জীবনকে ভালোবাসি সত্য, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়।’
বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, স্বদেশপ্রেম যেসব বৈশিষ্ট্য দ্বারা উজ্জ্বল সেগুলো হল- আত্মত্যাগ, বীরত্ব, সরলতা, শর্তহীনতা, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব, কর্তব্য এবং একাত্মবোধ।
দেশপ্রেমের প্রকাশ ও দৃষ্টান্ত : প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মধ্যে কোনো সংকীর্ণ চিন্তা থাকে না। দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধিই দেশপ্রেমিকের সর্বক্ষণের চিন্তা ও কর্মের বিষয়। দেশের স্বার্থকে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে থাকেন। নিজের অহংকার, মেধা, প্রজ্ঞা ও গৌরব স্বদেশের জন্য নিবেদন করেন। স্বদেশের যে কোনো গৌরবে দেশপ্রেমিক মাত্রই গর্ববোধ করেন। তেমনি দেশের দুর্দিনে বা অমঙ্গলে শঙ্কিতচিত্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং নিঃশর্ত আত্মত্যাগী হয়ে ওঠেন। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে নির্দ্বিধায় জীবনকে উৎসর্গ করেন। যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিয়েছেন তীতুমীর, প্রীতিলতা। ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেছেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য শহীদ হয়েছেন, রফিক, বরকত, সালাম, জাব্বার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্ম-বিসর্জিত অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, লক্ষ লক্ষ মা-বোন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অকুতোভয় সৈনিকদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারি। দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল। এছাড়া উপমহাদেশের শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে দেশপ্রেমের অম্লান স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাছাড়া ইতালির গ্যারিবাল্ডি, রাশিয়ার লেনিন ও স্তালিন, চীনের মাও সেতুঙ, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভিয়েতনামের হো-চি-মিন, তুরস্কের মোস্তফা কালাম পাশা প্রমুখ ব্যক্তিগণ বিশ্বঅঙ্গনে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে নিজ নিজ মহিমায় ভাস্বর। দেশপ্রেমের উৎকৃষ্টতম সংগ্রামে আত্ম-বিসর্জিত অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, লক্ষ লক্ষ মা-বোন, রফিক, বরকত, সালাম এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অকুতোভয় সৈনিকদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারি। দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
দেশপ্রেমের উপায়:
পবিত্র ইসলাম ধর্মে ঘোষিত হয়েছে ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই, যে ধর্মে দেশকে ভালোবাসার নির্দেশ দেয়া হয় নি। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মানুষ জীবনে যেকোনো সময়ে যেকোনো স্থান থেকে দেশকে ভালোবাসতে পারে। স্বীয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের মধ্যে দেশপ্রেম নিহিত। জাতির জন্যে, দেশের জন্যে, প্রত্যেক মানুষের জন্যে, তা সে ছোটই হোক কি বড়ই হোক- তার কিছু না কিছু করার আছে। কৃষক কৃষি-উৎপাদন বাড়িয়ে, সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যসাধনার মাধ্যমেও দেশের প্রতি ভালোবাসা জ্ঞাপন করতে পারেন। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। নিজের দৈন্যদশাকে তুচ্ছ করতে হবে এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। তাইতো মমিরুজ্জামান জন্মভূমির প্রতি মানুষের তীব্র আবেগ কাব্যে প্রকাশ করেছেন এভাবে-
‘আমারও দেশেরও মাটির গন্ধে
ভরে আছে এই মন,
শ্যামল কোমল পরশ ছড়ায়ে
নেই কিছু প্রয়োজন।’
দেশপ্রেমের উগ্রতা : দেশপ্রেম যেখানে মানুষের এক উন্নতবৃত্তি, সেখানে তা ত্যাগ-তিতিক্ষার মহৎ বৈভবে উদ্ভাসিত, সেখানে তা গৌরবের বস্তু, অহংকারের বিষয়। কিন্তু দেশপ্রেম যেখানে অন্ধ ও উগ্র, সেখানে জাতির জীবনে তা বিপজ্জনক। সেখানে তা ডেকে আনে এক ভয়াবহ সর্বনাশা পরিণতি। উগ্র দেশপ্রেম দিকে দিকে শুধু স্বজাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই নেশা মানুষের শুভবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে। জাতিতে জাতিতে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়। একদিন ইউরোপ ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের রক্তাক্ত হানাহানিতে মত্ত। অল্প সময়ের ব্যবধানেই দু দুবার রক্তক্ষরা বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবোধেরই অনিবার্য পরিণাম। স্বাদেশিকতার উগ্রতায় তাই মানুষের চির অকল্যাণ, চির অশান্তি। এতে নেই জাতির বাঞ্ছিত সমৃদ্ধি।
দেশপ্রেম ও রাজনীতি : স্তুত রাজনীতিবিদদের প্রথম ও প্রধান শর্তই হল দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমের পবিত্র বেদীমূলেই রাজনীতির পাঠ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ দেশের সদাজাগ্রত প্রহরী। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদদের চেহারা ভিন্ন। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মহত্তর, বৃহত্তর কল্যাণবোধ থেকে ভ্রষ্ট। ব্যক্তিক ও দলীয় স্বার্থচিন্তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রবল। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, মানুষের প্রয়োজনে সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার সাধনা, দেশপ্রেমের অঙ্গীকার ও সার্থকতা, তা এখন প্রায়ই অনুপস্থিত।
দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম : স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। বরং স্বদেশপ্রীতির ভেতর দিয়ে বিশ্বপ্রীতির এক মহৎ উপলব্ধি, জাগরণ। স্বদেশ তো বিশ্বেরই অন্তর্ভুক্ত। স্বদেশপ্রেম যদি বিশ্বমৈত্রী ও আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। স্বদেশবাসীকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ বিশ্ববাসীকে ভালোবাসতে শেখে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষ-বিশ্বপ্রেমের এই বাণীকে জাতীয় জীবনে গ্রহণ করলেই সংকীর্ণ, অন্ধ জাতীয়তাবোধ থেকে আমাদের মৃক্তি আসবে।
দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে সম্পর্ক : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতে, জাতীয়তা ও স্বদেশপ্রেম যখন সঙ্কীর্ণতার অন্ধকূপে বন্দি হয়ে উগ্র ছিন্নমস্তা রূপ ধারণ করে, তখন বিশ্বপ্রেম পদদলিত হয়। স্বদেশকে একমাত্র পরম প্রিয় মনে করে আমরা বিশ্বকে শত্রু মনে করি এবং তাকে ধ্বংস করবার জন্য ধাবিত হই। তখন শুভ বিচার-বুদ্ধি স্বদেশপ্রেমের অন্ধ আবেগে লুপ্ত হয়। ফলে পরস্পর হানাহানি এবং অবারিত রক্তক্ষয় অনিবার্যরূপে দেখা দেয়। আর, নানা মারণাস্ত্র আবিষ্কারের ফলে সেই হানাহানি অচিরেই ধারণ করে বিভীষিকাময় রূপ। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণ দুটি প্রণিধানযোগ্য-
“ও আমার দেশের মাটি, তোমার’পরে ঠেকাই মাথা,
তোমাতে বিশ্বময়ীর- তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।”
উপসংহার :
‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়
দাসত্বশৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়।’
-রঙ্গলাল
দেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ ও অমূল্য সম্পদ। একটি মহৎ গুণ হিসেবে পত্যেক মানুষের মধ্যেই দেশপ্রেম থাকা উচিত। দেশপ্রেমের মূল লক্ষ্য মানুষকে ভালোবাসা। দেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই অংশ বিশেষ। ব্যক্তিস্বার্থকে ত্যাগ করে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে ভালোবাসাই দেশপ্রেম। আর দেশের ঊর্ধ্বে সমগ্র পৃথিবীকে ভালোবাসাই বিশ্বপ্রেম। বিশ্বপ্রেমের মধ্য দিয়ে সকলের সাথে উদার ভ্রাতৃত্ব ঘোষণা করে বলতে হবে-
‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া
দেশে দেশে মোর দেশ আছে আমি সেই দেশ লব জুঝিয়া।’
সুতরাং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কিছু না কিছু অবদান রাখা প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
[ একই প্রবন্ধ আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]
ভূমিকা : বৃহত্তর অর্থে মানুষ ধরিত্রীর সন্তান। কিন্তু পৃথিবী সুনির্দিষ্ট অর্থে তার জন্মপরিচয়ের ঠিকানা নয়। প্রতিটি মানুষ জন্ম নেয় পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে, যা তার কাছে তার স্বদেশ। এই স্বদেশের সঙ্গেই গড়ে ওঠে তার নাড়ির সম্পর্ক। স্বদেশের জন্যে তার মনে জন্ম নেয় নিবিড় ভালোবাসা। এই ভিন্নধর্মী অনন্য ভালোবাসাই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম। এই প্রেমই স্বদেশের প্রতি গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধাকে আবেগ-নিটোল করে তোলে। কবির কণ্ঠে তারই আবেগাপ্লুত প্রগাঢ় উচ্চারণ-
’ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’
স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ : যে মাটিতে মানুষ জন্ম নেয়, যে মাটির আলো-বাতাস, অন্ন-জলে সে বেড়ে ওঠে তার প্রতি তার প্রাণের টান না থেকে পারে না। জন্মভূমির ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের প্রতি থাকে তার এক ধরনের আবেগময় অনুরাগ। জন্মভূমির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার শেকড়ের বন্ধন। স্বদেশের প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি এই অনুরাগ ও বন্ধনের নাম স্বদেশপ্রেম। মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি মানুষের যে চিরায়ত গভীর ভালোবাসা তারই বিশেষ আবেগময় প্রকাশ ঘটে স্বদেশপ্রেমের মধ্যে। জন্মভূমির এক চির আরাধ্য, চির পবিত্র, চির ভাস্বর মাতৃসম ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে মানুষের হৃদয়ে। স্বদেশপ্রেমের সেই তীব্র আবেগের বাণীরূপ আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ বন্দনায় :
স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তি : দেশ ও দেশের প্রতি মানুষের যে বন্ধন ও আকর্ষণ তা থেকেই স্বদেশপ্রেমের জন্ম। আর সেই কারণে জন্মভূমি মানুষের কাছে কেবল সকল দেশের সেরা নয়, তাকে স্বর্গের চেয়েও সেরা বলে মনে হয়। এই স্বদেশ চেতনাই কবি জীবনানন্দের অন্তরে সঞ্চার করেছিল এক অতিরেক আবেগের :
বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই
আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।
স্বদেশপ্রেম মানবচিত্তে ফাল্গুধারার মতো সদা সহমান থাকে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে তার আবেগোচ্ছল উৎসারণ ঘটে। যখন দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় জাতির ভাবসম্মিলনের, তখন দেশাত্মবোধ ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ভেদ ভুলে একই ভাবচেতনা দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে। স্বদেশপ্রেমের সেই শুভ উদ্বোধনে তখন অন্তর জুড়ে বাজে স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা স্মৃতি দিয়ে তৈরি স্বদেশ বন্ধনার গান : ‘সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’ স্বদেশ প্রেমে উদ্বেল চিত্ত কামনা করে,
‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।’
আবার কখনো পরাধীনতার দুঃখ বেদনায়, ভিনদেশী শাসকের শাসন-শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুক্তিব্রতে সামিল হবার সময়ে স্বদেশপ্রেম জাতীয় জীবনে জাগরণ ঘটায়, ঘটায় নব চেতনাময় দুর্বার প্রাণশক্তির উদ্বোধন
’স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়’
স্বদেশের লঞ্ছনা মোচনের আকাঙ্ক্ষায় মানুষের অন্তরে মন্দ্রিত হয় আত্মত্যাগের মহামন্ত্র :
’নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই’
স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতির অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রেরণাময় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একই চেতনায় একপ্রাণ হয়ে মহৎ লক্ষ্য সাধনে ব্রতী করে। মানব-সম্প্রীতি গড়ে তুলে শুভকর্মে ব্রতী হওয়ায় তখন স্বদেশপ্রেম উজ্জীবনী প্রেরণার কাজ করে:
কাহাকেও তুমি ভাবিও না পর হিন্দু-মুসলমান
ব্রাহ্ম, বৌদ্ধ, যেই হোক সে যে স্বদেশের সন্তান।
প্রীতির নয়নে চাহ যদি সবা পানে তাহারা নয়নমণি
স্বদেশের শুভ চাহ যদি লহ সবারে আপনা গনি।
কখনো কখনো স্বদেশপ্রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিদেশে ভিন্নতর জীবন-পরিবেশে। তখন স্বদেশের মানুষ ও প্রকৃতির জন্যে জাগে অসীম আকুলতা। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে অনেক সুখের মধ্যে থেকেও দেশের তরুলতা ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন জীর্ণ কুটিরের জন্যে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
স্বদেশেপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ : কেবল সংকটে, স্বাধীনতা সংগ্রামেই যে দেশপ্রেমের স্ফুরণ হয় এমন নয়। শিল্প-সাহিত্য চর্চায়, দেশগঠন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনাতেও স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দেশের কল্যাণে ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে, বিশ্ব সভ্যতায় অবদান রেখে দেশের গৌরব বাড়ানো যায়। বিশ্বসভায় দেশ মহিমান্বিত আসন লাভ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এফ. আর. খান. প্রমুখের অবদানে বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বর হয়েছে।
স্বদেশপ্রেমের বিকৃত রূপ : স্বদেশপ্রেম পবিত্র। তা দেশ ও জাতির জন্যে গৌরবের। কিন্তু স্বদেশপ্রেম যদি উগ্র ও অন্ধরূপ নেয় তখন তা কল্যাণের পরিবর্তে ধ্বংসের পথ রচনা করে। অন্ধ স্বদেশপ্রেম উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিতে জাতিতে সংঘাত ও সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জার্মানিতে হিটলার ও ইতালিতে মুসোলিনি উগ্র জাতীয়তা ও অন্ধ দেশপ্রেমের যে নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ লোককে বীভৎস মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। বিপন্ন হয়েছিল বিশ্বমানবতা।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম : স্বদেশপ্রে বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। স্বদেশপ্রেম যদি বিশ্বমৈত্রী ও আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। স্বদেশবাসীকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ বিশ্ববাসীকে ভালোবাসতে শেখে। বিশ্বজননীর বুকের আঁচলের ওপর যে দেশজননীর ঠাঁই রবীন্দ্রনাথ তাঁর অমর বাণীতে বলে গেছেন সে কথা :
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা
তোমাতে বিশ্বময়ীর- তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে বিশ্বমৈত্রীর গভীর যোগসূত্র আছে বলেই রবীন্দ্রনাথ, শেকসপিয়র, আইনস্টাইন কেবল স্ব-স্ব দেশের নন, তাঁরা সমগ্র মানব জাতির।
দেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রতিভূ : দেশে দেশে যাঁরা দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করে বরণীয় স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁরা সারা বিশ্বের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব বাঙালি অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে নেতাজী সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ চিরদিন আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বহু রাষ্ট্রনায়ক দেশ ও জাতিকে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইতালির গ্যারিবাল্ডি, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার লেনিন, চীনের মাও সেতুঙ, ভিয়েতনামের হো. চি. মিন, তুরস্কের মোস্তফা কামাল পাশা, ভারতের মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ দেশপ্রেমের জন্যেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণের দেশপ্রেম বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে।
উপসংহার : দেশপ্রেম মানুষের জীবনের অন্যতম মহৎ চেতনা। তা মানুষকে স্বার্থপরতা, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভেদাভেদ থেকে উর্ধ্বে উঠতে সহায়তা করে। উদ্বুদ্ধ করে দেশের কল্যাণে স্বার্থত্যাগ করে আত্মনিবেদনে। তাই ক্ষমতার লোভ ও দলীয় স্বার্থ চিন্তা কখনো সত্যিকার দেশপ্রেম হতে পারে না। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। একুশ শতকের পৃথিবীতে বিশ্ব সভায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্যে আজ দরকার দেশগঠনের কাজে সকলকে উদ্বুদ্ধ ও সমবেত করা। এজন্যে চাই ঐক্যবদ্ধ দেশব্রতী জাতীয় জাগরণ। তাহলেই দেশ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারায় অগ্রসর হতে পারবে। দেশগঠনে আমরা যেন শুভ চিন্তা ও ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করতে পারি।
How can I download it?
ReplyDeleteI think u cant.bt u can take a screenshot and save it in ur phone gallary.....
DeleteThank you vary
Deletemuch
If you search it on chrome then there is a download option on the menu bar.
Deletethanksforthehelp
ReplyDeleteThanks
ReplyDeletethank you sooooooooooooooooo much
ReplyDeleteThanks
ReplyDeletetnq
ReplyDeletenice
ReplyDeleteIt is very small for my examanition
ReplyDeletepoint আর বেশি হলে ভাল হত । উদ্ধৃতি ঠিক আসে। ৷ �� ��
ReplyDeleteতাহলে আপনি কয়েকটা পয়েন্ট বলেন যেগুলো দেওয়া যায় ।
DeleteThanks for this write by soroj
ReplyDeleteভাল 😊😊😊
ReplyDeleteহাদিস থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিলে ভালো হতো
ReplyDeleteঠিক কথা
Deletepointবেশি হলে ভাল হত
ReplyDeleteখুবই ভালো রচনা।
ReplyDeleteSo helpful!
ReplyDeleteআরো বেশি হলে ভালো হতো
ReplyDeletesodesh prem rochonar extra point
Deletearektu point hole valo tu..amnite sobb okk ache...
ReplyDeleteAro ekto besi Mara cassi
ReplyDeleteI want many point
ReplyDeleteBangladeshis shararitu
ReplyDeleteIt is so nice and helpfull
ReplyDeleteThanks for this
ভালো হয়েছে।তবে সংকেত আরো বেশি হলে ভালো হতো।
ReplyDeleteআচ্ছা এই বছর কুমিল্লা বোর্ডের জন্য ৮ম শ্রেনির গুরুত্বপূর্ন রচনা কোনগুলো হতে পারে..?
ReplyDeleteNice composition but point few.Small thanks.
ReplyDeleteভালোই হল, কিন্তু পয়েন্ট গুলোহ আরোহ হলে আরো ভালো হতো,, ধন্যবা,
ReplyDeleteNice composition
ReplyDeleteAmar dorkari shob rochonagulo ei website e peyechi. So thank you
ReplyDeleteNice composition
ReplyDeleteIt's very nice and helpful
ReplyDeleteDownload option or PDF download option Should be available! 😭
ReplyDeleteDear, PDF Download option Added
Delete